ভেবেছিলাম রোজারমজানের দিন শুধু ইসলামিক ছাড়া আর কোন বিষয়ে লিখব না। কিন্তু আমার কাছে ’ ভালো ‘ আর ‘ ইসলামিক ‘ দুটাই সমার্থক।
আমরা যারা সাদা দেশে থাকি তারা ভালোভাবেই জানি এরা কেমন। কিন্তু যারা কোনদিন এইসব দেশে থাকি নাই তাদের মনে এই প্রশ্নটা কমন। গল্পের নায়ক মিঃ হ্যারল্ড একজন ৮৫ বছরের বৃদ্ধ। লম্বা প্রায় ছয় ফুট। সুঠাম দেহ। বুঝতে অসুবিধা হয় না যৌবনে একজন সুদর্শন ও আকর্ষণীয় যুবক ছিলেন। তারই সহধর্মীনি মিসেস লুইস। বয়স ৮৩। উচ্চতায় ৩ ফুট ৯ ইঞ্চি।
বাংলায় আমরা যাদের বলি ‘ বামন’ . তাদের ৬০ বছরের বিবাহিত জীবন। কোন সন্তানাদি নাই। এখনো একে অপরের হয়ে সুখের জীবন যাপন করছেন। শুধু এতটুকু বললেই মিঃ হ্যারোল্ডের চরিত্রের একটা দিক সম্পর্কে সম্ম্যক ধারণা পাওয়া যায়। বাকিটা তারপরও বলি। থাকেন আমাদের পাশের বাড়িতে। দোতলা কাঠের বাড়ি। চারপাশে মোটামুটি জায়গা আছে। দোয়ারের মাঝখানে বড় একটা আমগাছ সারা বাড়িটাকে ছায়া দিয়ে রেখেছে।
আমরা নতুন ভাড়াটে হয়ে এসেছি পাশের বাড়িটাতে। দুই বাড়ির মাঝখানে মাথার চেয়ে একটু উঁচু কাঠের পাতের বেড়া। পাতগুলার মাঝখান দিয়ে কোথাও কোথাও অল্প একটু আধটু ফাঁক এবং এবাড়ি ওবাড়ির দোয়ারের কিছু অংশ দেখা যায়। ছয় মাস হয়ে গেল পড়শী হিসেবে আমাদের মধ্যে কোন পরিচয় নাই। এটা সাদাদের রীতিও না। পাশের বাড়িতে কে থাকে এটা নিয়ে ওরা নাক গলায় না। এটাকে অনেক সময় অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপও মনে করা হয়। কিন্তু আমার স্ত্রী একজন নাছোড়বান্দা। শত হলেও বাঙালি মেয়ে। ছয় মাস কাটিয়েছেন ধৈর্য্য ধরে। আর পারছেন না। একদিন হাজির হলেন এক বাটি তরকারি নিয়ে মাঝখানের কাঠের বেড়ার এই পাশে। অপর পাশে বৃদ্ধ দুইজন থাকেন দোতলায়। রাতের বেলায় যখন ঘরের বাতি জ্বলে তখন স্পষ্টই দেখতে পাই ওদেরকে। আমাদের দিকে ওদের রান্না ঘরটা আর খাবারের টেবিল। প্রতিদিন তিন বেলা অনেক্ষন পাশাপাশি বসে ওদেরকে খাবার খেতে দেখা যায়। আজ দুপুর বেলাও তার ব্যতিক্রম নয়। আমার স্ত্রী তরকারির বাটি হাতে বেড়ার এই পাশে দাঁড়িয়ে ওদের দোতলার জানালা দিয়ে দেখা দুজনেরই দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন। বাম হাতের উপর বাটিটা রেখে ডান হাত দিয়ে ওটাকে টাচ করে নলা তুলার ভঙ্গিতে মুখের কাছে নিয়ে বার বার বুঝানোর চেষ্টা করছেন যে এটা একটা খাবার। হাত দিয়ে ইশারা করে ডাকছেন নিচে এসে বাটিটা নিয়ে যেতে।বৃদ্ধ হলেও ওদের দুজনই এখনো বেশ শক্ত সামর্থ্য। কিন্ত পাশের বাড়ির মহিলার এমন অদ্ভুত আচরণ দেখে স্পষ্টতই বুঝা যাচ্ছিল একটু ভেবাচেকা খেয়ে গেছেন এবং বুঝতে পারছিলেন না কি করবেন। অনেক্ষন পর বৃদ্ধ লোকটা সিদ্ধান্ত নিলেন নিচে আসার।
বেড়ার অপর পার্শে এসে সন্দেহের ভঙ্গিতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করছিলেন বাটিতে কি। স্ত্রী আমার প্রফেশনে ডাক্তার হওয়াতে অনেক ভাল ইংলিশ বলেন এবং অনেক্ষন চেষ্টা করার পর বুঝাতে সক্ষম হলেন যে এটা একটা খাবার যা উনি পড়শীর সাথে শেয়ার করতে চান। এটা একটা গুড gesture ছাড়া আর কিছুই নয়। অবশেষে বৃদ্ধ পড়শীটি খাবারটি নিল।
সপ্তাহ দুই পরের কথা। বিকেল বেলা। দরজায় করা নাড়ার শব্দ। খুলে দেখি পড়শী বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা একটা কেক হাতে দাঁড়িয়ে। বৃদ্ধটা বললেন, আমাদের বিবাহ বার্ষিকী ছিল আজকে। আমরা রেস্টুরেন্টে খেয়েছি এবং তোমাদের জন্যে নিয়ে এসেছি ছোট্ট কেকটা। বলার পরে ভিতরে এসে বসলেন। এর মধ্যে স্ত্রী ও দুই মেয়ে এসে জয়েন করলো। আমার দুই মেয়ে তখন রাস্তার উল্টা পার্শে অবস্থিত বিরাট GRAMAR স্কুলটার ছাত্রী। Harold জানালেন উনি স্কুল পরিচালনা কমিটির সদস্য। দুই মেয়েকে কুশলাদিসহ পড়াশুনার ব্যাপারে বিস্তারিত জিজ্ঞেস করলেন।
এমনিভাবে যতই দিন যেতে থাকে দুই পরিবারের মধ্যে আন্তরিকতা আরো ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। Harold জানালেন তার বাবা এসেছিলেন Denmark থেকে এবংসেই হিসেবে উনারা ডেনিশ। আরো জানালেন লুইসকে কিভাবে বিয়ে করেছিলেন। তাদের ঘরে কোন সন্তানাদি হয় নাই। তবে ভাতিজারা আছেন এবং থাকেন শহরের অন্য প্রান্তে। আরেকদিনের কথা বাসায় visit করতে গিয়ে দেখি লুইস একা। জিজ্ঞেস করতেই বললেন Harold নিচে ব্যায়াম ঘরে বন্ধুদের নিয়ে পুল খেলছে। আমাকে এবিং স্ত্রীকে বিছানার পাশে বসতে বললেন । স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে জানালেন প্রথম দিন আমার স্ত্রী যখন দেওয়ালের ঐপাশ থেকে বিশেষ ভঙ্গিতে ডাকছিল তখন ওরা দুজনেই প্রথমে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। লুইস অনেক সুন্দর করে কথা বলে এবং প্রতিবারই দুই মেয়ে সম্পর্কে বিস্তারিত জিজ্ঞেস করে। একপর্যায়ে উঠে গিয়ে টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা লিখিত কাগজ নিয়ে এসে হাসতে হাসতে আমাদের সামনে ধরে এবং বলে এটা পড়। বলতে বলতে কেমন জানি একটু উদাস হয়ে গেল। বলতে লাগলো এটা লুইসকে লিখা হ্যারোল্ডের চিঠি। ছিচল্লিশ বৎসর আগে লিখা। আজো সে যত্ন করে রেখে দিয়েছে। মাঝে মধ্যেই বের করে পড়ে। হ্যারল্ড যে লুইসকে কতটা ভালোবাসে তার একটা সুন্দর চিত্র এখানে আছে।
অল্প কিছুদিন পরেই আমরা ভাড়া বাসাটা ছেড়ে দেই। চলে আসি নতুন একটা বাসা কিনে ঠিক সাথের আরেকটা পাহাড়ের চূড়ায়। মনের দিক থেকে শক্ত হলেও হ্যারোল্ড আর লুইস দুজনেরই আছে অনেক বার্ধক্য জনিত রোগ। আশ্চর্য বিষয় আমাদের বাঙালি সমাজে কোন বয়োবৃদ্ধ লোক যার আছে অনেক শারীরিক সমস্যা কোন একজন ডাক্তারের সাথে পরিচয় হওয়ার পরপরই অন্য কিছু চিন্তা না করেই বলতে থাকে নিজের রোগের কথা এবং জানতে চায় এর চিকিৎসা। কিন্ত গত এক বছরে পরিচয় হওয়ার পরে বেড়েছে ঘনিষ্ঠতা কিন্ত এক বারের জন্যেও বলে নাই নিজেদের অসুস্থতার কথা। প্রতিবারেই দেখা হওয়ার পর শুধু জিজ্ঞেস করে আমাদের আর আমাদের বাচ্চাদের কথা। শুধু হালকা ভাবে জিজ্ঞেস করাই নয় জানতে চায় খুটিনাটি সবকিছু। যেমন আমার বাচ্চাদের কার কোন সাবজেক্ট ভালো লাগে, কোন সাবজেক্টে দুর্বলতা আছে দুর্বলতা কাটানোর জন্যে অভিবাবক হিসেবে আমরা কি ব্যবস্থা নিয়েছি। তারপর আমার এবং আমার স্ত্রীর ডাক্তারি কেমন যাচ্ছে। যথেষ্ট রুগী হচ্ছে কিনা, রুগীরা আমাদের সাথে ভাল ব্যবহার করছে কিনা, প্রাকটিসকে আরো গতিশীল করার জন্যে আমরা আর কি কি করতে পারি, দেড় দুইঘন্টা যতক্ষণই কাছে থাকে প্রসঙ্গ শুধুই আমরা। নিজের থেকে নিজেদের সম্পর্কে কোন কথাই বলে না যতক্ষণ না আমরা জিজ্ঞেশ করি। বাড়িটা যখন কিনলাম তখন বাড়িতে উঠার আগেই Harold নিজে গাড়ি চালিয়ে পাহাড়ে উঠে একটু ঢালুতে পার্ক করে দুই হাঁটুতে প্রচন্ড আর্থ্রাইটিসের ব্যথা সত্ত্বেও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে উপরে উঠে বাড়ির প্রতিটা ঘর দরজা জানালা চেক করে গেছে ঠিক আছে কিনা।নিজের যন্ত্র পাতি নিয়ে পরে এসে একটা দরজায় ভিতর থেকে নতুন একটা এক্সট্রা ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়ে যায়। প্রতিবার যখন আসতো হাতে একটা কিছু খাবার নিয়ে আসতো। লক্ষ্য করলো আমরা ওয়েস্টার্ন স্টাইলের কিছু খাই না। তখন নিজের বাড়িতে দোয়ারের এক পাশে অল্প একটু জায়গা আলাদা করে ঘেরাও করে সেখানে আমাদের জন্য দেশীয় শাকসবজি চাষ শুরু করল। বেগুন , ঢেড়শ , টমেটো , সিম , কুমড়া এমনকি কাঁচা মরিচ কোনটাই বাদ নাই। এগুলার কোনোটাই ওরা খায় না। এগুলা শুধুই আমাদের জন্য। তখন প্রায় নব্বই বছর বয়স তাদের নিজেদেরই কত হেল্প দরকার। আমাদের জন্য কিছুই করতে হবে না। বার বার নিষেধ করা সত্যেও কিছুই মানে না। শুধু বলে আমরা নাকি খুব ভাল মানুষ। Harold নিজের কাছে আমাদের মেইন দরজার একটা চাবি রেখেছে। প্রতি মঙ্গল বারে মধ্য বেলায় আমরা যখন চেম্বারে আর দুই মেয়ে স্কুলে তখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এসে তাজা আনাজ তরকারি ফ্রিজ ভর্তি করে রেখে যায়। বিনিময়ে কিছুই নেয় না। এই কথাগুলা আমাদের অনেকেরই বিশ্বাস হবে না। না হওয়ারই কথা। আমি মোটেই বাড়িয়ে বলছি না। বরং কমিয়ে লিখছি। কারণ এই ছোট পরিসরে এতো কিছু লিখা সম্ভব নয়। মধ্যে আকারের অস্ট্রেলিয়ার উত্তর দিকে অবস্থিত রোখাম্পটন নামক আমাদের শহরটিতে বেয়াল্লিশটি বাঙালি পরিবার আছে। আমাদের সাথে হ্যারল্ড – লুইসের এই সম্পর্কের কথা সবাই জানে।
আত্মীয় না হয়েও একজন সাদা মানুষ যে কত আপন হতে পারে তার আরো অনেক উদাহরণ আছে। তারা কোন স্বার্থের কথা চিন্তা করে না। শুধু দিয়েই যায়। আরেকজন ব্যক্তি আমার খুব কাছের হয়েছিল। তার নাম Glenda Martin. আমার ক্লিনিকের প্র্যাক্টিস ম্যানেজার। আমার চেয়ে ৭ বছরের বড়। সদা হাসি মুখ। আমার স্ত্রী যথার্থই বলতো সে আমার মা। মা যেমন সন্তানকে আগলিয়ে রাখে। গ্লেন্ডা তেমনি আমাকে এবং আমার ব্যবসাকে আগলিয়ে রাখতো। আমার কোটি টাকার ব্যবসার লেনদেনের সমস্ত ভার শুধু তার হাতে রেখেই আমি নিশ্চিন্তে ঘুমুতে পারতাম। এটাও বাঙালিদের সবাই জানতো।
উপসংহারে বলতে চাই সবাই নয় তবে বেশির ভাগ সাদারাই ভাল চরিত্রের এবং সহানুভূতিশীল। আমাদের যারা বিদেশে থাকেন তাদের কম বেশি সবাই এটা স্বীকার করবেন ।