শিশির,বেইজিং:
গেল দশ বছরে চীনের জনগণ অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। দেশে চলছে সংস্কার এবং নানা ক্ষেত্রে অর্জিত হয়েছে অসাধারণ সব অগ্রগতি। এখন আমরা কিছু সংখ্যার মাধ্যমে গেল দশ বছরে চীনের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরছি।
১০ বছর ধরে চীনের অর্থনীতির বৃদ্ধির গড় গতি ছিল ৬ শতাংশের বেশি। জিডিপি ৫৩.৯ ট্রিলিয়ন ইউয়ান থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২১ ট্রিলিয়ন ইউয়ানে। মার্কিন ডলারে এটি ১৮ ট্রিলিয়ন। ফলে চীন বিশ্বের দ্বিতীয় স্থান দখল করে রেখেছে। চীনের মাথাপিছু জিডিপি ৬৩০০ ডলার থেকে বেড়ে ১২৪৭১ ডলারে উন্নীত হয়েছে। মানুষের জীবনযাপনের মানও লক্ষ্যণীয়ভাবে উন্নত হয়েছে।
২০১২ থেকে ২০২১ পর্যন্ত বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের হিস্যা ১১.৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৮ শতাংশ ছাড়িয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতির উন্নয়নে চীনের অবদান ৩০ শতাংশ ছাড়িয়েছে, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ।
গেল ১০ বছরে চীন থেকে বিদায় নিয়েছে চরম দারিদ্র। চীনে মোট ৯ কোটি ৮৯ লাখ ৯০ হাজার মানুষ দারিদ্রমুক্ত হয়েছে। তার মানে গড়ে একবছরে ১ কোটি চীনা দারিদ্রমুক্ত হয়েছেন। চীনের ৮৩২টি দরিদ্র জেলা ও ১ লাখ ২৮ হাজারটি দরিদ্র গ্রামও দারিদ্র থেকে বের হয়েছে। জাতিসংঘের ২০৩০ টেকসই উন্নয়ন এজেন্ডার চেয়ে ১০ বছর আগে চীন তার লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন করেছে।
১০ বছরে চীনে গঠিত হয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম ও উন্নয়নশীল মাঝারি আয়ের গ্রুপ। তার সদস্য সংখ্যা ৪০ কোটির বেশি। ২০২২ সালে মহামারির নেতিবাচক প্রভাব থাকলেও চীনের সামাজিক ভোক্তা পণ্যের খুচরা বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪৪ ট্রিলিয়ন ইউয়ান। তা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ভোগ্য বাজার ও বৃহত্তম অনলাইন খুচরা বাজার। সে সঙ্গে টানা ১৪ বছর ধরে চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম আমদানি বাজারের অবস্থান ধরে রেখেছে।
গত ১০ বছরে চীনা আবাসিক নিষ্পত্তিযোগ্য আয় ১৬,৫০০ ইউয়ান থেকে বেড়ে ৩৬,৮৮৩ ইউয়ানে পৌঁছেছে। গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচন ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প চালু হবার সঙ্গে সঙ্গে শহুরে বাসিন্দাদের তুলনায় গ্রামীণ বাসিন্দাদের নিষ্পত্তিযোগ্য আয় আরও দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পায়। আগামী ১৫ বছরে চীনে মাঝারি আয়ের গ্রুপের লোকসংখ্যা ৮০ কোটি হবে বলে অনুমান করা হয়।
চীনের গবেষণা ও উন্নয়ন ব্যয় ২০১২ সালের ১ ট্রিলিয়ন ইউয়ান থেকে বেড়ে ২০২২ সালে ৩.০৯ ট্রিলিয়ন ইউয়ান হয়েছে। সামাজিক গবেষণা ব্যয়ের মধ্যে মৌলিক গবেষণা আয়ের অনুপাত ৪.৮ থেকে বেড়ে ৬.৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। চীনে গবেষকদের সংখ্যা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি। মৌলিক গবেষণা ও নবায়ন জোরদার হচ্ছে। কোন কোন কেন্দ্রীয় প্রযুক্তি নিয়ে চীন যুগান্তকারী অর্জন করেছে। মনুষ্যবাহী মহাকাশযান, চন্দ্র এবং মঙ্গল অনুসন্ধান, গভীর সমুদ্র এবং গভীর স্থল অনুসন্ধান, সুপার কম্পিউটার, স্যাটেলাইট ন্যাভিগেশন, কোয়ান্টাম তথ্য, পারমাণবিক শক্তি প্রযুক্তি, নতুন জ্বালানি, বিমান তৈরি এবং বায়োমেডিসিনসহ নানা ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে।
চলতি বছর হচ্ছে ‘এক অঞ্চল এক পথ’ প্রস্তাবের ১০ম বার্ষিকী। ‘এক অঞ্চল এক পথ’প্রস্তাবের আওতায় গেল ১০ বছরে চীন বিশ্বের ১৫১টি দেশ, ১৩২টি আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে ২০০টির বেশি সহযোগিতামূলক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ২০১৩ থেকে ২০২২ পর্যন্ত চীন ও সংশ্লিষ্ট দেশের রপ্তানি ও আমদানির পরিমাণের বৃদ্ধি ছিল প্রতিবছর গড়ে ৮.৬ শতাংশের বেশি।
১০ বছরে চীন পরিষেবা বাণিজ্য মেলা, আন্তর্জাতিক আমদানি মেলা, ভোক্তা এক্সপোসহ ধারাবাহিক আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে। চীনের উদ্যোগে ২১টি অবাধ বাণিজ্য পরীক্ষামূলক এলাকা ও হাইনান অবাধ বাণিজ্য বন্দর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আরসিইপি চুক্তি কার্যকর হবার পর থেকে অংশগ্রহণকারী দেশের সঙ্গে চীনের আমদানি ও রপ্তানি পরিমাণ, অ-আর্থিক সরাসরি বিনিয়োগের পরিমাণ লক্ষ্যণীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। ২০২২ সালে চীনের বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে এবং টানা ৬ বছর ধরে চীন বিশ্বের বৃহত্তম পণ্য বাণিজ্যে দেশ হয়ে আসছে।
২০২২ সালের শেষ নাগাদ চীনের পরিবহন নেটওয়ার্ক ৬০ লাখ কিলোমিটার ছাড়িয়েছে। এটি পূর্ববর্তী ১০ বছরের তুলনায় দ্বিগুণ। চীনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম হাই-স্পিড রেল ও সড়ক পথ নেটওয়ার্ক। চীনে চালু হয়েছে ২৩ লাখ ১০৯ হাজারটি ৫জি বেস স্টেশন এবং প্রতিটি জেলায় চালু হয়েছে ৫জি সেবা, এবং প্রতিটি গ্রামে চালু হয়েছে ব্রডব্যান্ড। চীনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম ও উন্নত ইন্টারনেট অবকাঠামো এবং সব শহরে চালু হয়েছে গিগাবাইট ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক। পাশাপাশি, চীন বিশ্বের সবচেয়ে গতিশীল এবং সম্ভাব্য ডিজিটাল পরিষেবা বাজার। মোট ১৪০ কোটি মানুষের মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০০ কোটির বেশি। তা ২০১২ সালের তুলনায় ৮০ শতাংশের বেশি।
গেল ১০ বছরে চীনে নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে ১.৩ কোটি কর্মসংস্থান। কৃষক কর্মীর সংখ্যা ২৯ কোটি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকের সংখ্যা ৮ কোটি। চীনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিশ্বে বৃহত্তম শিক্ষা, সামাজিক নিশ্চয়তা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা।
গেল ১০ বছর চীন ছিল আরও নিরাপদ একটি দেশ। মানুষের নিরাপত্তা সূচক ২০১২ সালের ৮৭.৫৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২১ সালের ৯৮.৬২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। চীন বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ দেশের মধ্যে অন্যতম হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে।
১০ বছরে চীন বার্ষিক ৩ শতাংশ জ্বালানি ব্যবহার করে ৬.৬ শতাংশ অর্থনীতি উন্নয়নকে সমর্থন করেছে। ২০২০ সালে কার্বন নির্গমন ৪০-৪৫ শতাংশ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন করেছে। চীনে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনের পরিমাণ ৫৮০ কোটি টন হ্রাস পায় এবং প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্বের বৃহত্তম পরিষ্কার বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা।
২০২২ সালের নভেম্বর মাসে চীনের ঐতিহ্যিক চা তৈরি ও তার সংশ্লিষ্ট ঐতিহ্য বিশ্ব অ-বৈষয়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। বর্তমানে চীনের আছে ৪৩টি বিশ্ব অ-বৈষয়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য- তা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চীনে নিবন্ধিত যাদুঘরের সংখ্যা ৬০০০টি এবং এর মধ্যে ৯০ শতাংশ বিনামূল্যে সবার জন্য উন্মুক্ত।
গেল ১০ বছরে চীনের উন্নয়নে লক্ষণীয় ও ঐতিহাসিক সফলতা অর্জিত হয়েছে। আগামী ১০ বছরের নতুন যাত্রা শুরু হচ্ছে। আরও সমৃদ্ধ জীবনযাপনের উদ্দেশ্যে এগিয়ে যাচ্ছে চীনারা।
সূত্র : চায়না মিডিয়া গ্রুপ