আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
থাং রাজবংশে চিয়ানজেন নামে একজন বিশিষ্ট সন্ন্যাসী ছিলেন। তিনি জাপানে গিয়েছেন, জাপানে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করেছেন এবং জাপানি সংস্কৃতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছেন।
চিয়ানজেন (৬৮৮-৭৬৩), চিয়াংসু প্রদেশের ইয়াংচৌ শহরের বাসিন্দা। শৈশব থেকেই তার পরিবারের প্রভাবে, তিনি বৌদ্ধধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন। ১৪ বছর বয়সে, তিনি অধ্যয়নের জন্য ছাং’আন ও লুওইয়াং ভ্রমণ করেন, বিখ্যাত শিক্ষকদের কাছ থেকে শেখেন, পদ্ধতিগতভাবে বৌদ্ধ ক্লাসিক অধ্যয়ন করেন এবং বৌদ্ধ ধর্মের শাস্ত্রীয় বিধান নিয়ে তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে অধ্যয়ন করেন। ৭১৩ সালে, তিনি তার নিজ শহর ইয়াংচৌতে ফিরে আসেন এবং উচ্চ খ্যাতি উপভোগ করে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার শুরু করেন।
চীন ও জাপানের গভীর ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। জাপানের ধর্মীয় সংস্কৃতি, চরিত্র ও পোশাক, জীবনযাত্রার রীতিনীতি, স্থাপত্যশৈলী এবং জাতীয় ব্যবস্থা সবই প্রাচীন চীন থেকে প্রভাবিত হয়েছে। তৃতীয় শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে অষ্টম শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত, বৌদ্ধধর্ম চীনে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং বিকশিত হয়। এই সময় জাপানও পরিবর্তনের জন্য বৌদ্ধধর্মের ওকালতি করে এবং চীন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। বিপুল সংখ্যক জাপানিজ সন্ন্যাসী চীনে অধ্যয়ন করতে এসেছিলেন এবং চীনা ভিক্ষুরাও জাপানে ধর্মপ্রচার করতে গিয়েছিলেন। উভয় পক্ষের মধ্যে একটি অভূতপূর্ব বিনিময় শুরু হয়েছিল। এই সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে সুদূরপ্রসারী ঘটনাটি ছিল যখন চিয়ানজেন এবং তার দল জাপানের আমন্ত্রণে জাপানে গিয়ে ধর্ম প্রচার করেন। তিনি চীন ও জাপানের সভ্যতার বিকাশে বিরাট অবদান রেখেছিলেন।
৭৪১ সালে, চীনে অধ্যয়নরত একজন জাপানি সন্ন্যাসী সম্রাট শোমু মিকাদোর নির্দেশে চিয়ানজেনকে ধর্ম প্রচার এবং শাস্ত্র শেখানোর জন্য এবং জাপানি ভিক্ষুদের আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য জাপান ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানান। এই অনুরোধের সামনে, চিয়ানজেন কঠিন ভ্রমণের অসুবিধা সত্ত্বেও তাতে সম্মত হন। তিনি বিশ্বাস করেন যে, এটি সব সংবেদনশীল প্রাণীর জন্য সমানভাবে বৌদ্ধধর্ম শেখার জন্য একটি সুযোগ। তাঁর চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে, তাঁর ২১জন শিষ্য চিয়ানজেনের সঙ্গে জাপানে যেতে চান।
জাপান দূতের অনুরোধে সম্মত হওয়ার পরে, চিয়ানজেন পূর্বমুখী যাত্রার প্রস্তুতি শুরু করেন। জাপানে তাদের চারবার ভ্রমণ ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু চিয়ানজেন এবং তার দল হাল ছেড়ে দিতে অস্বীকার করেন। তিন বছর পর, তারা পঞ্চমবার পূর্বদিকে যাত্রা শুরু করেন। এ সময়, তারা আবার সমুদ্রে বিপদের মধ্যে পড়েন। আবারও তারা ব্যর্থ হন। আর এবারের যাত্রায় চিয়ানজেন অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার দুটি চোখই অন্ধ হয়ে যায়। ৭৫২ সালে থাং রাজবংশে পাঠানো জাপানি দূত আবার চীনে আসে, চিয়ানজেনের সাথে দেখার জন্য ইয়াংচৌতে আসে এবং তাকে একসাথে জাপানে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানায়। ৭৫৩ সালে, চিয়ানজেন এবং তার দল অবশেষে জাপানে পৌঁছায়। এভাবে, চিয়ানজেন প্রথম জাপানে যাবার আমন্ত্রণ গ্রহণ করা থেকে জাপানে চূড়ান্তভাবে যেতে মোট ১১ বছর সময় লাগে। তিনি ৫ বার ব্যর্থ হন এবং ৩৬জন মানুষ জীবন হারায়।
চিয়ানজেন জাপানে ১০ বছর অতিবাহিত করেন। জাপান সরকারের সাথে একত্রে তিনি জাপানি বৌদ্ধধর্ম সংস্কারকাজ করেন। ফলে জাপানি বৌদ্ধধর্মের বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠিত হয়। যা শুধুমাত্র রাজদরবার বৌদ্ধধর্মের পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যবস্থাপনায় অবদান রাখে নি, বরং ভিক্ষুদের গুণমানও নিশ্চিত করেছে। এছাড়া, জাপানে মন্দির ও সন্ন্যাসীদের মধ্যে বিনিময়ের জন্য এবং সারা বিশ্বের লোকদের বৌদ্ধধর্ম শেখানোর জন্য উৎসাহিত করতে চিয়ানজেন জাপানে একটি চীনা-শৈলীর উন্মুক্ত মন্দির প্রতিষ্ঠার আশা করেন। তাই, জাপানি সম্রাট জুনরেন থাং রাজবংশের মডেল অনুসারে একটি মন্দির নির্মাণ করেন এবং এর নাম দেন “তোশোদাই মন্দির”। জাপানি সন্ন্যাসীদের আনুষ্ঠানিকভাবে সন্ন্যাসী হওয়ার আগে তোশোদাই মন্দিরে অধ্যয়ন করতে হয়। তোশোদাই মন্দির পরবর্তীতে জাপানের বৌদ্ধ ধর্মের বিধি-বিধান সম্প্রদায়ের পৈতৃক মন্দিরে পরিণত হয় এবং চিয়ানজেনকে বিধি-বিধান সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে গণ্য করা হয়।
চিয়ানজেনের পূর্বমুখী যাত্রা জাপানে সমৃদ্ধ থাং রাজবংশের সংস্কৃতি নিয়ে আসে। তিনি যেসব শিষ্যকে জাপানে নিয়ে গেছে, তারা সবাই গুণী এবং প্রতিভাবান মানুষ। তারা থাং রাজবংশের সংস্কৃতি সক্রিয়ভাবে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। যাতে জাপানের অনেক প্রতিভাবান সন্ন্যাসী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে চীনা সংস্কৃতি শেখার সুযোগ পেয়েছেন। অধিকন্তু, জাপান সরকার শর্ত দিয়েছিল যে ক্লাসিক এবং বিধি-বিধানগুলি চীনা ভাষায় পড়ানো উচিত, যা নিঃসন্দেহে জাপানে চীনা ভাষার প্রসার ও বিকাশ উন্নীত করেছে। এ ছাড়া, ঐতিহ্যবাহী চীনা ওষুধ, শিল্প ও কারুশিল্প, ভাস্কর্যের ম্যুরাল, স্থাপত্য নকশার ধারণা এবং শৈলী, যা চিয়ানজেন জাপানে নিয়ে এসেছেন, তা জাপানে প্রচার করা হয়েছে। জাপানি জাতি তাদের নিজেদের ব্যবহারের জন্য থাং রাজবংশের রাজনীতি, আদর্শ, সংস্কৃতি এবং ব্যবস্থা থেকে শিক্ষা নিতে চায়।
সম্রাট গেনমেই-এর শাসনামলে, জাপান এমনকি থাং রাজবংশের রাজধানী ছাং’আন অনুসরণ করে নারা শহর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। বিখ্যাত ‘নারা আমল’ ছিল জাপানের স্বর্ণযুগ এবং সেই সময়ও ‘থাং শৈলী সংস্কৃতি’ মূলধারায় পরিণত হয়েছিল। চিয়ানজেনের পরে, জাপানে চীনা সাংস্কৃতিক দূতগণ নিরবচ্ছিন্নভাবে ভ্রমণ করেছেন। বৌদ্ধ সন্ন্যাসী দাওলং, ফুথুওশান বিশিষ্ট সন্ন্যাসী ইশান ইনিং এবং মিং রাজবংশের জু শুন শুই “জাপানের কনফুসিয়াস” নামে পরিচিত। তারা সবাই চীন-জাপানি বিনিময়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
‘সব নদী সমুদ্রে মিশে যায়, সহনশীলতাই মহান চরিত্র।” বৈচিত্র্যে সভ্যতার বিনিময় হয়, বিনিময়ের কারণে একে অপরের কাছ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করা যায় এবং পারস্পরিক শিক্ষাগ্রহণের কারণে তা বিকাশ লাভ করে। সভ্যতার মধ্যে বিনিময় এবং পারস্পরিক শিক্ষাগ্রহণ মানবসভ্যতার অগ্রগতি এবং বিশ্বের শান্তিপূর্ণ বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। প্রতিটি সভ্যতারই অনন্য চেতনা ও ঐতিহ্য রয়েছে এবং সেসব মানুষের আত্মার সম্পদ। বিভিন্ন সভ্যতা ছড়িয়ে পড়ার প্রক্রিয়ায় তা অন্তর্ভুক্ত। সমতা, সম্মান, সহনশীলতা এবং পারস্পরিক শিক্ষার উপর ভিত্তি করে যোগাযোগের একটি ফর্ম বেছে নেওয়া একে অপরের কাছ থেকে শেখা এবং সভ্যতার মধ্যে সাধারণ অগ্রগতি জোরদার করবে। আদর্শের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সমাজের দ্বন্দ্ব সমাধান করা হবে এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অবস্থা উন্নত করা হবে।
লেখক: ইয়াং ওয়েই মিং স্বর্ণা, চায়না মিডিয়া গ্রুপ।