শিশির:
জাদুঘর একটি শহরের গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক এবং এটা সভ্যতা, ইতিহাস ও গণস্মৃতি বহন করে। বেইজিং শহরের ইতিহাস ৩ হাজার বছরের এবং এর মধ্যে ৮শ বছরই এটি রাজধানী হিসেবে রয়েছে। বেইজিংয়ে রয়েছে নানা ধরনের জাদুঘর এবং প্রতিটি জাদুঘরের রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। এখানে রয়েছে চীনের বৃহত্তম ও সবচেয়ে সমৃদ্ধ জাদুঘরের ক্লাস্টার।
বেইজিংকে জাদুঘরের শহর হিসাবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা উত্থাপন করা হয় ২০২০ সালে। তখন থেকে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস প্রদর্শনী হল, চায়না আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটস আর্ট মিউজিয়ামসহ বড় বড় জাদুঘর নির্মিত হয়। জাতীয় ও শহর পর্যায়ের জাদুঘর সম্প্রসারণ ও পুনর্নিমাণ করা হয়। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২২ সালের শেষ নাগাদ বেইজিংয়ে নিবন্ধিত জাদুঘরের সংখ্যা দাঁড়ায় ২১৫-এ এবং প্রতি বছর ৫ কোটিরও বেশি দর্শনার্থী জাদুঘরগুলো পরিদর্শন করে।
বৈশিষ্ট্যময় ও সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্য বেইজিংয়ের জন্য একটি সোনালী নেম কার্ড ও মূল্যবান সম্পদ। বেইজিং পুরাকীর্তি ব্যুরোর প্রধান চেন মিং চিয়ে জানান, বেইজিং জাদুঘর শহর উন্নয়ন পরিকল্পনা ২০২৩-২০২৫-এ বলা হয়েছে, ২০২৩ সাল নাগাদ বেইজিংকে একটি জীবন্ত জাদুঘর হিসাবে গড়ে তোলা হবে।
ছুটির সময়ে জাতীয় প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘরে অনেক হলুদ ভেস্ট পরা এবং হাতে লাউডস্পিকার ধরা তরুণ গাইড দেখা যায়। সতের বছর বয়সি লিউ ইউয়ু ফেই তাদের একজন। তিনি ১০ বছর ধরে স্বেচ্ছসেবক গাইড হিসেবে এখানে কাজ করছেন। যদিও তিনি এখনও কলেজে পড়ছেন, তবে যখনই সময় পান জাদুঘরে এসে সবাইকে সাংস্কৃতিক নিদর্শনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তার মাধ্যমে আরও বেশি মানুষ চীনা পুরাকীর্তি সম্পর্কে জানতে পারছেন।
জাতীয় প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘরের ইতিহাস ৭০ বছরের এবং কয়েক প্রজন্মের মানুষ এটি পরিদর্শন করেছে। সবাই যাতে এটা পরিদর্শন করতে পারে, সেজন্য জাদুঘর কর্তৃপক্ষ ধারাবাহিক ব্যবস্থা নিয়েছে। যেমন স্কুল ও আবাসিক এলাকায় সাংস্কৃতি অনুষ্ঠান আয়োজন করা, অনলাইনে প্রদশর্নী আয়োজন করা ইত্যাদি। সম্প্রতি তারা বেইজিংয়ে একটি শাখা জাদুঘর খোলার প্রস্তুতি নিয়েছে।
জাতীয় প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘরের প্রধান মেং ছিং চিন জানান, যদিও পুরাকীর্তি, নিদর্শন, জীবাশ্ম ও মডেল – সবই স্থির, তবে তাদের মূল্য এবং যে তথ্য তারা বহন করে তা জীবন্ত। আন্তঃবিভাগীয় গবেষণা, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ, ডিজিটালাইজেশন এবং বিদেশে প্রদর্শনী আয়োজন করাসহ নানা ব্যবস্থার মাধ্যমে একটি ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর ২৪ ঘন্টার জাদুঘর হিসাবে কাজ করতে পারে।
চলতি বছর জাতীয় প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘর প্রদর্শনীর বোড, নিদর্শন, জীবাশ্ম ও চলচ্চিত্র নিয়ে চীনের চিয়াং সি, ফুচিয়ানসহ নানা পাহাড়ি অঞ্চলের স্কুলে যায় সেগুলোর প্রদর্শনে। গ্রামীণাঞ্চলের শিশুদের কাছে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান পৌঁছায় এসব প্রদর্শনীর মাধ্যমে। ২০১৪ সালে এ কার্যক্রম শুরু হবার পর থেকে জাতীয় প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘর চীনের ১২টি প্রদেশ ও অঞ্চলের মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলের ২ লাখেরও বেশি
শিক্ষার্থীদের জন্য গবেষণা ও শিক্ষামূলক কার্যক্রম আয়োজন করেছে।
জাতীয় প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘর একদিকে নানা বিষয় ও নানা পদ্ধতির মধ্যেমে প্রদর্শনীর আকার সম্প্রসারণ করছে, আবার অন্যদিকে আরও বিশাল আকারে তারা প্রদর্শনী আয়োজন করছে। এটা বেইজিংকে একটি জাদুঘরের শহর হিসাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
২০২০ সালের এপ্রিল মাসে জাতীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে বেইজিং দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা ২০১৯-২০৩৫’ প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, জাতীয় জাদুঘর প্রদর্শনী আয়োজনের দক্ষতা ও গণপরিষেবা প্রদানের মান উন্নয়ন করা এবং বেসরকারি ও ব্যক্তিগত জাদুঘরগুলোকে সদ্ব্যব্যবহার করে বেইজিংকে একটি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ও বর্ণময় জাদুঘর শহর হিসাবে নির্মাণ করা হবে।
আন্তর্জাতিক জাদুঘর পরিষদের (আইসিওএম) এশিয়া-প্যাসিফিক ফেডারেশনের চেয়ারম্যান আন লাই সুন বলেন, জাদুঘর একটি উন্মুক্ত ব্যবস্থা। সেখানে শুধু পুরাকীর্তি সংরক্ষণ এবং সেগুলো নিয়ে গবেষণা করা হয় এমন নয়, বরং এ সম্পদগুলো যত বেশি সম্ভব মানুষের সামনে তুলে ধরা হয়। এই ধারণা থেকে বেইজিংয়ের জাদুঘরগুলো স্কুল, কমিউনিটি ও সড়কে গিয়ে সবার জন্য প্রদর্শনীর চেষ্টা করছে।
বেইজিং শহরের থুং চৌ এলাকায় সিছু নামে একটি মাধ্যমিক স্কুল আছে। ছয় মাসের প্রচেষ্টায় এখানে নির্মিত হয়েছে গ্র্যান্ড ক্যানেল ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট ওয়ার্ফ-এর মডেল। এর দৈর্ঘ্য ৫ মিটার এবং প্রস্থ ১.৫ মিটার। দশটি দোকান, ৩০টি পেশা, কয়েক ডজন ব্যক্তি এবং ৩০টি কাঠের নৌকা দিয়ে হাজার বছর আগের গ্র্যান্ড ক্যানেলের সমৃদ্ধ দৃশ্য আবার দেখানো হয়েছে এখানে। এর নির্মাণ কাজে অংশগ্রহণ করে স্কুলের শিক্ষার্থীরা। তারা যেমন কাঠমিস্ত্রিদের ঐতিহ্যবাহী কৌশল শিখেছে, তেমন শিখেছে গ্র্যান্ড ক্যানেলের ইতিহাস।
বেইজিং ওয়েন ওয়াং ক্য কাঠের নিদর্শন জাদুঘরের উদ্যোগে এবারের কার্যক্রম আয়োজন করা হয়। এ জাদুঘর ঐতিহ্যবাহী চীনা কাঠের কাজের সংস্কৃতি তুলে ধরে এবং ঐতিহ্যের ওপর গুরুত্ব দেয়। এ পর্যন্ত ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ তাদের স্টুডিওতে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বেইজিংয়ে শতাধিক জাদুঘর ও স্কুলের মধ্যে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। জাদুঘর ও স্কুলগুলো যৌথভাবে অনুষ্ঠান আয়োজন করে, জাদুঘরগুলো স্কুলে শিক্ষাদান করে এবং শিক্ষার্থীরা জাদুঘর পরিদর্শন করে।
বেইজিংয়ের পুরনো এলাকায় অবস্থিত অনেক জাদুঘর। নিষিদ্ধ নগরী জাদুঘর এবং চীনা জাতীয় জাদুঘরের মতো বিস্তৃত পরিসরের জাদুঘর যেমন আছে, তেমনি আছে বেইজিং প্রাচীন ভবন জাদুঘর, চীনা রেলপথ জাদুঘরসহ বিষয়ভিত্তিক জাদুঘরও। এছাড়া কোম্পানি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত জাদুঘরও আছে এখানে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শহরের পুরনো অঞ্চলের বিখ্যাত মানুষদের পুরনো বাড়িঘরও জাদুঘর হিসেবে সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে।
এই গ্রীষ্মে বেইজিং সি চা হাই হ্রদের উত্তর তীরে কুও সৌ চিং স্মৃতি ভবনে খুব প্রাণবন্ত দৃশ্য দেখা যায়। এখানকার সংগীত অনুষ্ঠান, কবিতা আবৃত্তি, বই মেলাসহ নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সবার দৃষ্টি আর্কষণ করে। ২০১৯ সাল থেকে কুও সৌ চিং স্মৃতি ভবনের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করছে একটি পেশাদার দল। ২০১৯ সালে এখানে পর্যটকের সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় ৫ গুণ বেড়েছে। স্মৃতি ভবনের প্রধান চাং পেং বলেন, বেইজিংকে জাদুঘর শহর হিসাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ নগর জাদুঘর, জাতীয় জাদুঘর – এমন বড় বড় জাদুঘর মহাধমনীর মতো কাজ করেছে, তবে বেইজিংয়ে যে অনেক ছোট ছোট জাদুঘর রয়েছে, সেগুলোও কৈশিকনালীর মতো পরিহার্য।
একটি হুথুং বা ঐতিহ্যের ধারক গলিতে রয়েছে আধা-আধুনিক চীনের ইতিহাস। সি চিয়া হুথুং ছিল ছিং রাজবংশ আমলে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া শিক্ষার্থী নির্বাচনের পরীক্ষা-কক্ষ। সেখানে বাস করেছেন অনেক বিখ্যাত মানুষ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন চীন সফর এসেছিলেন, তখন তিনিও এ হুথুং পরিদর্শন করেন এবং অনেক বন্ধুর সঙ্গে এখানে দেখা করেন।
সি চিয়া হুথুং জাদুঘরের প্রধান পান হ্য ওয়ে জানান, হুথুংয়ের ভিত্তিতে নির্মিত এটি বেইজিংয়ে প্রথম জাদুঘর। ২০১৩ সালে নির্মাণের পর কর্তৃপক্ষ হুথুংয়ের বাসিন্দার কাছ থেকে পুরনো আসবাবপত্র, পুরনো ফটো ও পুরনো বস্তু সংগ্রহ করে এবং হু থুংয়ের কণ্ঠ নামে একটি কার্যক্রম আয়োজন করে। শিল্পীরা এখান এসে হুথুংয়ে পোকার ডাক, ছোট ব্যবসায়ীদের প্রচারমূলক বক্তৃতাসহ নানা কণ্ঠ সংগ্রহ ও রেকর্ড করেন।
সি চিয়া হু থুংয়ে বড় একটি ঘরকে কমিউনিটির মিটিং রুমে রূপান্তরিত করা হয়েছে। এখানে জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানী শিক্ষা কার্যক্রম আয়োজন করা হয়। আজকাল বেইজিং শহরের উন্নয়নে জাদুঘরের কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। বিখ্যাত মানুষদের পুরনো বাড়িঘর, পরিত্যক্ত শিল্প-পার্ককে জাদুঘরে পরিণত করা হচ্ছে। বিভিন্ন কোম্পানি ও গ্রামও নিজ নিজ ইতিহাস নিয়ে নানা ধরনের জাদুঘর তৈরি করছে।
ইন্টারনেট, বিগ ডেটা, এআইসহ নানা প্রযুক্তির দ্রুত উন্নয়ন হচ্ছে আর জাদুঘরের উন্নয়নে প্রযুক্তিগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বেইজিংয়ের কু লোও (ড্রাম টাওয়ার) এখন পর্যটকের মধ্যে জনপ্রিয় একটি দর্শনীয় স্থান। এখানে ‘সময়ের কাহিনী’ নামে একটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ইমারসিভ ডিজিটাল প্রদর্শনী, ইন্টারেক্টিভ অভিজ্ঞতাসহ নানা পদ্ধতির মাধ্যমে সবার কাছে কু লোওয়ের স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য, আশেপাশের বাসিন্দাদের রীতি-নীতি পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়।
পশ্চিম বেইজিংয়ে শৌকাংয়ে (ক্যাপিটাল স্টিল কোম্পানি)-এর পুরনো কারখানা ও শিল্প-পার্ককে জাদুঘর ও আর্ট গ্যালারিকে পরিণত করা হয়েছে। এখানে পাশের ইউং তিং নদীর ইতিহাস ও কাহিনী ৩৬০-ডিগ্রী ইমারসিভ ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে সবাইকে জানানো হয়। জাদুঘরের প্রধান হান ইউয়ু জানান, জাদুঘরটি চালু হয়েছে মাত্র এক বছরের মতো এবং ইতোমধ্যে তারা প্রাচীনকালের কবিতা, ইউং তিং নদীর ইতিহাসসহ তিন থিমের প্রদর্শনী আয়োজন করেছে। এ প্রদর্শনীগুলোতে হলোগ্রাম, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ও এআইসহ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।
ডিজিটাল প্রযুক্তির সাহায্যে সময় ও ভৌগলিক ব্যবধান অতিক্রম করতে পারে দর্শকরা। যেমন ‘গ্রিসের টেরাকোটা যোদ্ধাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ’ নামের একটি প্রদর্শনীতে টিজিটাল প্রযুক্তির সাহায্যে দর্শকরা টেরাকোটা যোদ্ধাদের মধ্যে দাঁড়ানোর অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে এবং প্রাচীন গ্রিসের ভাস্কর্যের সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলতে পারে। প্রযুক্তি সময় ও আকাশের সীমানা ভেঙে দিয়েছে এবং আরও আকর্ষণীয় করে পুরাকীর্তিকে সবার সামনে তুলে ধরছে।
চলতি বছর বেইজংয়ের ৮টি সামাজিক সংস্থা প্রাথমিক জাদুঘর হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছে। প্রাথমিক জাদুঘর মানে এ সংস্থাগুলোতে জাদুঘরের কিছু কার্যক্রম আছে, তবে আনুষ্ঠনিক জাদুঘরের শর্ত পূরণ করেনি। বেইজিং নিদর্শন জাদুঘর এগুলোর মধ্যে একটি। এ জাদুঘরের প্রধান লি সিয়াং কয়েক দশক ধরে নানা জিনিস সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে আসছেন। জাদুঘরে দেশ-বিদেশের ক্রীড়া বিষয়ক ২ হাজারের বেশি পুরাকীর্তি আছে। প্রাথমিক জাদুঘর হিসেবে নিবন্ধিত হবার পর আরও বেশি মানুষ এ জাদুঘরটি সম্পর্কে জেনেছে।
বর্তমানে বেইজিংয়ে ১ লাখ ১১ হাজার মানুষের জন্য গড়ে ১টি জাদুঘর আছে। ২০৩৫ সাল নাগাদ বেইজিংয়ে জাদুঘরের সংখ্যা ৪৬০ ছাড়িয়ে যাবে এবং প্রতি ১ লাখ মানুষের জন্য ২টি করে জাদুঘর হবে। আরও বেশি ব্যক্তিগত সংগ্রহ সারা সামাজের অভিন্ন সম্পদে পরিণত হচ্ছে।
সূত্র: চায়না মিডিয়া গ্রুপ।