একটা সময় আমরা গর্ব করে বলতাম আমাদের সোনার বাংলাদেশটি সবুজ শ্যামল রূপে গড়া। এ দেশের প্রকৃতি এবং আবহাওয়া ছিলো মানুষের জন্য অত্যান্ত স্বাস্থ্যকর।
গ্রামের ধান ক্ষেতের আইলে বা নদীর কিনারায় বসে কালে কালে বিভিন্ন কবি সাহিত্যিক লিখেছেন “এমন দেশটি কোথাও খুজে পাবে না-কো তুমি, সকল দেশের রানী সে-যে আমার জন্মভূমি”। বাংলাদেশকে নিয়ে কালজয়ী গান রচনা হয়েছে অগুনিত। সোনালী ধানের শীষ, নদীতে পাল তোলা নৌকা, খালেবীলে মাছ ধরা, মাঠের মাঝখানে অশত্থ গাছের ডালে বসে মন মাতানো সুরে গানের শব্দ এখন আর নাই।
কালের বিবর্তনে সব হারিয়ে গেছে। যান্ত্রিকতার যাতাকলে গ্রামের মাটির গন্ধ এখন আর নাকে আসে না। চারদিকে এখন ইট পাথরের শহর। গ্রামের মানুষগুলোর মাঝে এসেছে আমূল পরিবর্তন। সবাই কেন যেন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। কে মরলো আর কে বেঁেচ থাকলো, সেদিকে কারো কোন নজর নেই। একজনের বিপদে আরেকজন ঝাপিয়ে পড়তো। আর এখন আপন ভাই-বোন বা বাবা-মা ও শত্রু হয়ে যায়, শুধুমাত্র জমি সম্পত্তির লোভে। প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ঢুকলে চোঁখে পড়ে সম্পত্তির লোভে ভাইয়ের হাতে ভাই খুন। বহু ঘটনার স্বাক্ষী এখন শান্তির জনপদ এ বাংলাদেশের মানুষ। সম্প্রতি চট্টগ্রামে বাবার লাশ বাড়ীর উঠোনে ফেলে রেখেছে সন্তানেরা। কারন একটাই জমি।
যাই হোক এবার মূল প্রসঙ্গে আসি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বহু আগেই ঘোষণা দিয়েছেন বাংলাদেশের এক ইঞ্চি কৃষি জমিও যেন অনাবাদি বা খালি পড়ে না থাকে। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বাজারে এখন চালও আমদানি করতে হয় বাংলাদেশকে। সকল নিত্যপন্য এখন গরীব মানুষরে নাগালের বাহিরে। আয়ের তুলনায় ব্যয় বেড়েছে শতগুন। বাংলাদেশের ছোট্ট একটি উপজেলা রামগঞ্জ। জনসংখ্যা রয়েছে প্রায় সাড়ে ৪লাখ। মধ্যপ্রাচ্যসহ প্রবাসীদের আয়ের উপর এ এলাকার বেশিরভাগ মানুষের জীবন জীবিকা নির্ভর করতো। কিন্তু বিদেশের মাটিতেও ভালো নেই বাংলাদেশী ভাইয়েরা। কাজ নেই, অবৈধ হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে অনেক প্রবাসী। লক্ষ লক্ষ টাকা ঋণ নিয়ে পরিবারের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে বিদেশে পাড়ি জমানোর পরও বাধ্য হয়ে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হন। আর দুঃসহ জীবনের ভাগিদার হয়ে পরিবার, স্ত্রী-সন্তানসহ পারিবারিক জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। দেশে আসার পর দু-বেলা দু-মুঠো খেতে নেমে পড়েন রিক্সা চালানো বা চাষাবাদ করতে।
আবারও ব্যাংক, এনজিও বা বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে বাপ-দাদার দেয়া ছোট্ট জমিটিতে ধানসহ চাষাবাদ শুরু করেন, পরিবারের সদস্যদের মুখে খাবার তুলে দিতে। এছাড়া গ্রামের কৃষকরাও নতুন বোনা ধান চাষে স্বপ্ন দেখেন ফসলভরা মাঠের। গ্রামের হাজার হাজার কৃষক এখনো ধান চাষাবাদসহ সবজি চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, গত ১৫/২০ বছর থেকে অধ্যাবদি রামগঞ্জ উপজেলার বেশিরভাগ ফসলি জমির মাটি কেটে নেয়া হচ্ছে স্থানীয় ব্রীকফিল্ডগুলোতে। হাজার হাজার একর জমির টপসয়েল কেটে নেয়াসহ বেশিরভাগ জমি এখন পুকুরে পরিনত হয়েছে। ভূমিখেকো আর ব্রীকফিল্ড মালিকদের লোভের চোঁখগুলো এখন আবাদী জমির মাটি। চলতি মওসূমে চাষকৃত ধানের জমি থেকে চাষকৃত ধানগাছসহ মাটি কেটে পুকুর করা হচ্ছে কোথাও কোথাও। টপসয়েল কেটে ব্রীকফিল্ড বা খালি জায়গা ভরাটে নির্দিষ্ট আইন থাকার পরও রামগঞ্জ উপজেলার ভোলাকোট, ভাদুর, দেহলা, আথাকরা, শাহারপাড়া, নাগমুদ, টিউরী, ভাটরা, করপাড়া, চন্ডিপুর, ইছাপুর, নোয়াগাঁও, শৈরশৈ, পানিয়ালা, কাঞ্চনপুরসহ বিভিন্ন এলাকার জমির মাটি কেটে নেয়ায় কোথাও কোথাও পুকুরে পরিনত হয়েছে। বড় আকৃতির ভেকুমেশিন দিয়ে এসব আবাদী ও ধানগাছসহ মাটি কেটে নেয়াও হচ্ছে। আর সব মাটিই চলে যাচ্ছে অবৈধ ট্রলিতে করে ইটভাটাগুলোতে। শত শত ট্রলির কারনে গ্রামের রাস্তা দিয়ে পায়ে হেঁটে চলাও এখন কষ্টসাধ্য।
লক্ষ্মীপুর ১ রামগঞ্জ আসনের সাংসদ ড. আনোয়ার হোসেন খাঁন আইনশৃঙ্খলা সভাসহ বিভিন্ন সভা সেমিনারে দেদারছে মাটি কাটা বন্ধ, ট্রলি চলাচল বন্ধে বেশ কিছু পদক্ষেপসহ আইনী প্রক্রিয়ার কথা জানালেও কেউই তা মানছে না। প্রথম কয়েকদিন মাটি কাটা, ট্রলি চলাচল বন্ধ থাকলেও কোন এক অজ্ঞাত কারনে আবারও নতুন উদ্যেমে ব্রীকফিল্ড মালিক ও ট্রলি মালিকরা তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
আগে বিভিন্ন সময় ট্রলি চলাচল বন্ধ, টপ সয়েল কাটা বন্ধ, স্কুল ও জনবসতি এলাকায় ভাটা স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা, কাঠ পোড়ানো বন্ধে আইনী পদক্ষেপ গ্রহণ করে ভ্রাম্যমাণ আদালতে জরিমানা করলেও সম্প্রতি ভ্রাম্যমান আদালতে জরিমানা খুব একটা দৃশ্যমান নয়। এলাকাবাসীর দাবী জমির টপসয়েল (জমির উপরের অংশের মাটি) কাটা বন্ধ এবং আবাদী জমির মাটি কাটা বন্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে মারাত্মক বিপর্যের মুখে পড়তে পারে এ এলাকাসহ দেশের মানুষকে।
মাহমুদ ফারুক
সংবাদকর্মী ও সভাপতি: রামগঞ্জ প্রেস ক্লাব