সালাহ উদ্দিন শুভ্র:
ইউনেসকোর প্রথম নারী মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা বলেছিলেন, সব হত্যাই বেদনাদায়ক, কিন্তু যখন কোনো সাংবাদিকের মৃত্যু হয়, তখন জনগণ তার পক্ষে কথা বলার একটি কণ্ঠস্বর হারায়।
ব্যাপকভাবে গণতন্ত্রের চর্চা আছে এমন দেশের ক্ষেত্রে এ কথার অর্থ যতটা পরিষ্কার হয়, আমাদের দেশে সেভাবে উপলব্ধ হতে দেখা যায় না।
জামালপুরের বকশীগঞ্জে দুর্বৃত্তদের বর্বর হামলার শিকার বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জামালপুর জেলা প্রতিনিধি গোলাম রাব্বানী নাদিমের মৃত্যুর খবরে মনে পড়ল কথাটা।
সাংবাদিকতায় চাকরির সুবাদে প্রতিদিন অসংখ্য মৃত্যুর সংবাদ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে হয়। কে মারা গেল, কেন মারা গেল, কে মারল, নাম-পরিচয়, স্বজন-পুলিশ কী বলছে? অজস্র তথ্যের সন্নিবেশ ঘটাতে হয়। অনেক মৃত্যু থাকে দেশ কাঁপানো। দিন-রাত সেই মৃত্যুর সঙ্গে লেগে থাকতে হয়। সঠিক, নির্ভুল তথ্য যেন পায় পাঠক তার দিকে ক্লান্তিহীন নজর রাখতে হয়। পোড়া, ক্ষতবিক্ষত, বিকৃত মৃতদেহের ছবি দেখে যেতে হয় নির্বিকার। মাঝে মাঝে কিছু মৃত্যুতে ক্ষোভ, রাগ, শোককে চাপা দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করে যেতে হয়।
কখনো কোথাও আগুন লাগলে, ভবন বা ভূমিধস হলে–কোমর সোজা করে বসে থাকতে হয় সার্বক্ষণিক সর্বশেষ কী পরিস্থিতি তা জানানোর জন্য। আর যারা রিপোর্টিং করেন, তাদের তো মানসিক আর শারীরিক পরিশ্রম আরো কঠিন। আগুন, ধোয়া, রক্তাক্ত অথবা পোড়া মৃতদেহ, স্বজনদের আহাজারি, উদ্ধার কার্যক্রমের হুজ্জত থেকে নিজের অফিসে সঠিক সংবাদটা তাদের পাঠাতে হয়। লাশেরে পেছন পেছন ছুটতে হয় মর্গে। স্বজনদের কান্না, বিবমিষার সামনে দাঁড়িয়ে পরম নিষ্ঠায় নিজের কাজটুকু করে যেতে হয়।
কিন্তু একজন সাংবাদিককে যদি মেরে ফেলা হয়, তখন? এর ভারও একান্ত সাংবাদিকদের বহন করতে হয়। অন্য সব সংবাদের মতো হয়ে পড়ে সেই হত্যা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের হত্যার ঘটনা দেশজুড়ে আলোড়ন তোলে না। চাঞ্চল্য জাগায় না। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে অবশ্য বেশ আলোড়ন তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এ দুই নির্ভীক সাংবাদিককে হত্যার মামলার বর্তমান পরিস্থিতি সবাই জানে। কারা হত্যা করেছে, কেন করেছে কেউ এত বছরেও জানতে পারে নাই। এমনকি অভিযোগপত্রও দিতে পারে নাই আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা।
এরপর আরো অনেক সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন। তাদের নামও কেউ আমরা মনে করতে পারব না। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা বিভিন্ন সময়ে দেশে সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতনের তথ্য প্রকাশ করে। কিছু কিছু নির্যাতনের ঘটনা অবশ্য বেশ হই চই তৈরি হয়। দেশের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষকে তখন কথা বলতে দেখা যায়। এর বেশির ভাগই ঘটে আলোচিত পত্রিকা বা সাংবাদিকের ক্ষেত্রে। পুকুর যেমন আলোড়ন ওঠার পর শান্ত হয়ে যায় আবার, সাংবাদিকদের ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটে। আবার সব চুপচাপ থাকে নতুন কোনো নিপীড়ন না ঘটা পর্যন্ত।
গত বছর নভেম্বরে দেশে এক সাংবাদিকের ওপর নিপীড়নের ঘটনায় করা প্রতিবেদনে বিবিসি বাংলা মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বরাত দিয়ে জানায়, নির্যাতনকারীদের জন্য সরাসরি কোনো দায়মুক্তির আইন না থাকলেও প্রভাবশালী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সরকারি সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে সহজে ব্যবস্থা নিতে চায় না আইনি সংস্থাগুলো। ফলে সাংবাদিকদের ওপর সংগঠিত অপরাধ অনেকটা বিচারহীন থেকে যায়।
তথ্য ও মত প্রকাশের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন আর্টিকেল নাইনটিন বলেছে, বাংলাদেশে সাংবাদিকদের প্রতিকার চাওয়ার মতো সরকারি কোনো ব্যবস্থা নেই। নিপীড়নের শিকার হলে তাদের প্রচলিত আইনের মাধ্যমে যেতে হবে।
সংগঠনটির দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেছেন, ‘পাকিস্তানের মতো দেশে দুটি প্রভিন্সে জার্নালিস্ট প্রোটেকশন ল আছে, যেটা আমাদের দেশে নেই। এটা অত্যন্ত লজ্জার। এ ধরনের আইন থাকা খুবই দরকার। বরং (বাংলাদেশে) সাংবাদিক নির্যাতন করার আইন প্রচুর আছে, কিন্তু সাংবাদিককে রক্ষা করার কোনো আইন নেই।’
বাংলাদেশের সাংবাদিকদের অবস্থা অবশ্য এর চেয়েও করুণ। গোলাম রাব্বানী নাদিমের মৃত্যুর খবর প্রকাশের ক্ষেত্রেও দেখা যায় রাখ-ঢাক করতে হচ্ছে। স্থানীয় প্রভাবশালী কারো অনিয়ম বা অত্যাচারের সংবাদ প্রকাশের জেরেই তিনি খুন হন বলে জানতে পারছি নানাভাবে। তবে এখনো স্পষ্ট করে তার বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করা যায়নি। নিজের সহকর্মীকে হত্যার সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিতে সাংবাদিকদেরই পিছপা হতে হচ্ছে। ‘দুর্বৃত্ত’ শব্দের আড়ালে তাদের গোপন করতে হচ্ছে অভিযুক্তদের। কে যেন একবার বলেছিলেন, সাংবাদিকদের বর্তমান অবস্থা হলো হাত-পা বেঁধে কুমিরভর্তী পুকুরে ফেলে দেওয়ার মতো।
এ পরিস্থিতিতে বরাবার শুধু মনে হচ্ছে, একজন সাংবাদিককে হত্যা করলে কার কী যায় আসে! কিছু বিবৃতি, মানববন্ধন, ক্ষুব্ধ মতপ্রকাশের পর আবার সব স্বাভাবিক হতে থাকবে। একজন সাংবাদিকের মৃত্যু মানে যে জনগণেরই কণ্ঠস্বর রোধ করে দেওয়া, সেই গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধি আমাদের দেশেও তৈরি হোক– এ আশায় তবুও তাকিয়ে থাকি।
সূত্র: দৈনিক দেশ রূপান্তর অনলাইন।