জাকারিয়া মাহমুদ:
জিলকদের চাঁদ উঠে গেছে। হজের মৌসুম চলে এসেছে। শাওয়াল, জিলকদ, জিলহজ এ তিন মাস যার জন্য সুনির্ধারিত। পৃথিবীর আনাচে-কানাচে নগর বন্দর গ্রাম পাড়া মহল্লা থেকে মানুষ ছুটে চলছে মক্কা পানে। এহরামের শুভ্রতায় একাকার সবাই। এক নয়ন জুড়ানো দৃশ্য। তারা প্রেমিকের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ছুটে চলছে তার সকাশে। প্রেমিক মহামহিম আল্লাহ তায়ালা আহ্বান করে বলেছেন- ‘সামর্থ্যবান প্রত্যেকের ওপর বাইতুল্লাহ তথা আমার ঘর জিয়ারত করা বা হজ করা আমার দাবি। আমার অধিকার। যে ব্যক্তি প্রত্যাখ্যান করবে, অস্বীকার করবে তার জেনে রাখা উচিত, নিঃসন্দেহে আমি সৃষ্টিকুলের মুখাপেক্ষী নই’ (সূরা আলে-ইমরান-৯৭)। এটি কোনো মানুষের দাবি নয়। না কোনো বাদশাহর; বরং এটি বাদশাহর বাদশা রাজাধিকার মহামহিম আল্লাহ তায়ালার দাবি। সামর্থ্যবান বান্দার প্রতি সুস্পষ্ট ফরজ। অস্বীকারকারী নিঃসন্দেহে কাফের।
কোন উদ্দেশ্যে হবে হজ : আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় বান্দাদেরকে তার সকাশে ডেকেছেন। একান্তভাবে ডেকেছেন। সুতরাং শুধু তার জন্যই, তার সন্তুষ্টি কামনায়ই হতে হবে যাত্রা। নাম টাকা বা লোক দেখানোর উদ্দেশ্য হলে ফলাফল থাকবে শূন্য। ইরশাদ হয়েছে- ‘তোমরা আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে হজ ও ওমরাহ করো’ (সূরা বাকারা-১৯৬ )।
হজের ফজিলত : আর যদি বান্দা তার জন্যই হজ-ওমরাহ করে তাহলে পাবে এক মহা প্রতিদান। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনোরূপ অশ্লীল কথা বা গুনাহের কাজে লিপ্ত না হয়ে (হজের সব বিধি-বিধান পুঙ্খানুপুঙ্খ সম্পন্ন করল) আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে। (সে যেন) সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে ফিরে এলো’ (সহিহ বুখারি-১৪৩১)। অন্য এক হাদিসে আছে, ‘যে ব্যক্তি এই গৃহের হজ আদায় করল (এবং এ সময়ে) সে স্ত্রী সহবাস করল না বা অন্য কোনো অন্যায় কাজও করল না। (হজের কোনো বিধি-বিধান লঙ্ঘন করল না) সে এরূপ নিষ্পাপ হয়ে আগমন করবে যেমন মাতৃগর্ভ থেকে সদ্যজাত শিশু নিষ্পাপ হয়ে ভূমিষ্ঠ হয়’ (বুখারি-১৭০২)। এর চেয়ে আর বড় প্রতিদান কী হতে পারে! বুখারি শরিফের আরেকটি হাদিসে হজে মাবরুরকে তৃতীয় সর্বাধিক উত্তম আমল হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে (সহিহ বুখারি-১৪২৯)। অন্য এক হাদিসে মাকবুল হজের পুরস্কার জান্নাত বলা হয়েছে (বুখারি-১৬৫৮)। মাকবুল বা মাহরুর অর্থ হলো কবুল বা গ্রহণীয় হজ। যার জন্য প্রয়োজন হজের বিধি-বিধান আন্তরিকতার সাথে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আদায় করা সুতরাং এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা কাম্য।
হজ না করার পরিণাম : আর যদি সামর্থ্যবান হওয়া সত্ত্বেও হজ না করে প্রভুর প্রেমের আহ্বানে সাড়া না দেয়। তাহলে তার জন্য রয়েছে বড় ভীতিপ্রদ সতর্কবাণী। হজ করা থেকে বিরত থাকা ব্যক্তি আল্লাহর জিম্মাদারিতে থাকে না বলে ঘোষণা দিয়েছেন স্বয়ং বিশ্বনবী সা:। হাদিসে এসেছে- হজরত আলী রা: বর্ণনা করেন- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি আল্লাহর ঘর পর্যন্ত পৌঁছার (খরচ বহনের) মতো সম্বল (ধন-সম্পদ) ও বাহনের অধিকারী হওয়ার পরও যদি হজ না করে তবে সে ইহুদি হয়ে মারা যাক বা খ্রিষ্টান হয়ে মারা যাক তাতে (আল্লাহর) কোনো ভাবনা নেই’ (তিরমিজি)। সুতরাং সামর্থ্যবান ও হজের শর্ত পূরণকারী সব নারী-পুরুষের উচিত, হজ করার সামর্থ্য হওয়ার সাথে সাথে তা আদায় করা।
হজের প্রকার ভেদ : হজ মোট তিন প্রকার- ১. হজে ইফরাদ; ২. হজে কিরান ও ৩. হজে তামাত্তু।
এর মধ্যে সবচেয়ে উত্তম হলো হজে কিরান, তার পর তামাত্তু, তারপর ইফরাদ।
হজে ইফরাদ : শরিয়তের পরিভাষায় হজে ইফরাদ বলা হয় হজের মৌসুমে শুধু হজের নিয়ত করে (ওমরাহ নয়) ইহরাম বেঁধে হজের কার্যাবলি সম্পন্ন করা।
হজে কিরান : শরিয়তের পরিভাষায় হজের মৌসুমে এক সাথে ওমরাহ ও হজের নিয়ত করে ইহরাম বেঁধে প্রথমে ওমরাহ (এরপর ইহরাম না খুলে) করে একই ইহরামে হজের কার্যাবলি সম্পন্ন করা।
হজে তামাত্তু : শরিয়তের পরিভাষায় হজের মৌসুমে শুধু ওমরাহর নিয়ত করে ইহরাম বেঁধে প্রথমে ওমরাহ করা এরপর ইহরাম খুলে নতুনভাবে হজের নিয়ত করে হজের কার্যাবলি সম্পন্ন করা।
হজের ফরজ তিনটি : ১. মিকাত (রাসূল কর্তৃক নির্ধারিত স্থান) থেকে ইহরাম বাঁধা; ২. ৯ জিলহজ আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা ও ৩. ১০ জিলহজ সুবহে সাদিকের পর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্তের আগে বাইতুল্লাহ শরিফ তাওয়াফে জিয়ারত করা।
এর কোনো একটি ব্যত্যয় ঘটলে হজ নষ্ট হয়ে যাবে, পুনরায় হজ করা লাগবে।
হজের ওয়াজিব ছয়টি : ১. ৯ জিলহজ সূর্যাস্তের পর থেকে পরবর্তী সূর্যোদয় পর্যন্ত মুজদালিফায় অবস্থান করা। ২. সাফা-মারওয়ায় সায়ি করা। ৩. মিনায় শয়তানকে কঙ্কর নিক্ষেপ করা। ৪. ইহরাম খোলার জন্য মাথামুণ্ডানো বা চুল ছাঁটা। ৫. বিদায়ী তাওয়াফ করা। (মিকাতের বাইরের লোকদের জন্য) ৬. কোরবানি করা। (শুধু তামাত্তু ও কিরান আদায়কারীদের জন্য ওয়াজিব; অন্যদের জন্য নয়)
এগুলো যদি যথাযথভাবে আদায় করা না যায় তবে তা ছুটে যাওয়ার কারণে কোরবানি আবশ্যক হবে। হজের এ কাজগুলো আদায় করা ওয়াজিব বা আবশ্যক।
হজের সুন্নত ও মুস্তাহাব ৯টি : ১. যারা হজে ইফরাদ কিংবা কিরান করবে তাদের জন্য তাওয়াফে কুদুম করা। ২. তাওয়াফে কুদুমের প্রথম তিন চক্করে রমল করা। তাওয়াফে কুদুমে রমল না করে থাকলে তাওয়াফে জিয়ারাতে রমল করা। ৩. ৮ জিলহজ মক্কা থেকে মিনায় গিয়ে জোহর আসর মাগরিব এশা ও ফজর, এই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা এবং রাতে মিনায় অবস্থান করা।
৪. ৯ জিলহজ সূর্যোদয়ের পর মিনা থেকে আরাফার ময়দানের দিকে রওনা হওয়া। ৫. ৯ জিলহজ সূর্যাস্তের পর আরাফার ময়দান থেকে মুজদালিফার দিকে রওনা হওয়া। ৬. উকুফে আরাফার জন্য সে দিন জোহরের আগে গোসল করা।
৭. ১০, ১১ ও ১২ জিলহজ দিবাগত রাতগুলোতে মিনায় অবস্থান করা।
৮. মিনা থেকে বিদায় হয়ে মক্কায় আসার পথে মুহাসসাব নামক স্থানে কিছু সময় অবস্থান করা। ৯. ইমামের জন্য তিন খুতবা দেয়া। (ফতোয়ায়ে শামি-২/৪৬৭, ফতোয়ায়ে আলমগিরি-১/২১৯)
লেখক : শিক্ষার্থী, জামেয়া শরাইয়াহ, মালিবাগ, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক নয়া দিগন্ত অনলাইন।