হৃদয়ে বাবা
সাগুফতা ফারাহ মওদুদ
————–
আমারো দেশেরও মাটির গন্ধে ভরে আছে সারা মন
শ্যমল কোমল ও পরশ ছাড়া যে নেই কিছু প্রয়োজন !!
না আমি কোন গানের ছএ আপনাদেরকে শুনাতে আসিনি আজ, এই গানটি আমার বাবার পছন্দের গান, বাবা নাকি সবসময় গুনগুন করে গাইতেন।
অবশ্য আমি কিন্তু শুনিনি বাবাকে গাইতে, কারন বাবা যখন ১৯৭১ এ দেশের জন্য প্রান দিয়েছেন, তখন আমার বয়স ছিল মাএ নয় মাস।
আমার কাছে বাবা মানে হচ্ছে আমাদের ড্রইংরুমের বাবার বড় পোরটেটটা আর মার কাছে, বড় ভাই বোনদের কাছে, দাদীর কাছে শোনা সব গল্প আর তাঁর বীরগাথা।
আমার বাবা ১৯৭১ সালে রাজশাহীর এস.পি ছিলেন। ‘৭১ এর ৩১শে মার্চ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁকে ধরে নিয়ে যায় পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাপটেন সলমন মাহমুদ, আমরা আর কখনও তার খোঁজ পাইনি।
আমার বাবা শহীদ শাহ আব্দুল মজিদ ১৯৩৫ সালে রংপুরে জন্মগ্রহন করেন। দাদীর কাছে শুনেছি ছোটবেলা থেকেই বাবা মেধাবী ছিলেন। প্রথম হতেই বৃওি পাওয়া ছাএ বলে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত তাঁর পড়াশোনার জন্য কোন চিন্তা করতে হোত না।
১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টারস করার পর ১৯৫৭ হতে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত বাবা জগন্নাথ কলেজের অধ্যাপক ছিলেন ।
সেই সময়ে তিনি ক্যাডার সার্ভিসে পরীক্ষা দেন এবং উত্তীর্ণ হয়ে তদানীন্তন পাকিস্তান পুলিস সার্ভিসে যোগদান করেন।
পরবর্তিতে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি, বা হয়ত কোথাও গেছি বাবার উপরেই কোন অনুষঠান করতে .. অনেকেই যখন জেনেছেন আমি কার কন্যা , আবেগে আপ্লুত, শ্রদ্ধায় অবনত হয়েছেন বাবার কথা বলতে গিয়ে, বলেছেন বাবার মত শিক্ষক তাঁরা আর পাননি ! বাবা যেমন সুন্দর ছিলেন দেখতে, তেমন স্টাইলিশ, সব সময় সাদা শার্ট, সাদা প্যান্ট পড়তেন । উনার ছাএদের কথায় ‘ কি সএেটিস, কি প্লেটো, আমরা শুধু মুগ্ধ হয়ে স্যারের কথাই শুনতাম।’
তিন বছরের অধ্যাপনা জীবনে তিনি অত্যন্ত প্রিয় শিক্ষক হিসাবে গন্য হয়েছিল্ন তাঁর ছাএদের মাঝে।
১৯৬২ সালে বাবা সারদাহ পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষন নেন, তারপর ১৯৬৩ সালে চট্টগামে সহকারী এস.পি হিসাবে যোগদান করেন। ওই সালেই সেপ্টেম্বর মাসে নারায়নগনজে এস.ডি.পিও হিসাবে যোগদান।
১৯৬৫ সালে স্পেশাল ব্রাঞ্চে যোগদান এবং ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের দায়িত্য পালন করেন।
এই সময়ে জগন্নাথ কলেজের প্রিয় স্যার আব্দুল মজিদের কন্ঠ ঢাকার ছাএ মিছিলে উন্মও ছাএদের সংযত রাখত, শৃংখলায় আবদ্ধ রাখত। বাবার মধ্যে যেমন ছিল শিক্ষকের দৃঢ়তা, তেমনই ছিল ভালোবাসার অনুশাসন!
১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রাজশাহীতে পুলিশ সুপারের দায়িত্য নেন।
১৯৭১ সাল। মার্চ মাস। মার্চের সেই অসহযোগ আন্দোলনের সময় মার কাছে শুনেছি বাবা খুবই উওেজিত, চিন্তিত থাকতেন।
এলো ২৫ শে মার্চের ভয়াল রাত। আমাদের বাড়ীর চারিদিকে নাকি মিলিটারিতে ভরে গিয়েছিল। ২৬ শে মার্চ ডি আইজি মামুন মাহমুদ রহস্যজনকভাবে হারিয়ে যান তাঁর পরিবারের কাছ হতে !!
এসপির বাড়ীর পাশেই ছিল পদ্মা নদী, মা অনুরোধ করেছিলেন বাবাকে সরে যেতে। বাবা ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন, তিনি সরে গেলে কে দিবে নেতৃত্ব তার পুলিশ বাহিনীকে।
পাকিস্তানি সৈন্যরা পুলিশ লাইন অবরুদ্ধ করে রেখেছিল । বাবা এমাগত তাঁর ফোর্সঁদের পাশে থেকে সাহস যুগিয়েছেন যাতে তারা ছএভঙ না হয়ে যায়।
২৬ শে মার্চের পর বাবা হাইডআউটে চলে যান। তিনি অস্ত্রাগার খুলে দেন। তাঁর নেতৃত্বে ২৮ শে মার্চ পাকিস্তানি সেনাদের সাথে সম্মুখ সমর হয়। তারই ফলশ্রুতিতে ৩১ শে মার্চ পাকবাহিনীর রক্ত পিশাচ ক্যাপটেন আমার বাবাকে ডি.সি রাশিদুল হাসানের বাড়ী থেকে ধরে নিয়ে যায়।
আমার মা তখন নামায় পড়ছিলেন নিজের বাসায়, পাক সৈনরা তাকে নামাযটাও শেষ করতে দেয়নি, টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় ডিসির বাংলোয়। মা গিয়ে দেখেন মিলিটারিরা রাইফেল, বেয়োনেট তাক করে রেখেছে বাবার দিকে। বাবা খুব নার্ভাস ছিলেন, খুব ঘামছিলেন , আমার বড় বোন যে ছিল আমার বাবার খুব আদরের, সে তার রুমালটা বাবার হাতে দিয়েছিল, সেই রুমাল নিয়েই মুখ মুছে বাবা গেলেন আর ফিরলেন না। আমার মাকে বলা হয়েছিল জিজ্ঞাসাবাদের পর ফেরত দিয়ে যাওয়া হবে, বাবাও মাকে বলে গিয়েছিলেন ‘ আমি ফিরে আসব, তুমি দোয়া কর।’
কিন্ত দেশপ্রেমিক শাহ আব্দুল মজিদ আর ফিরে আসেন নি স্ত্রী, পুএ-কন্যা পরিবৃত ভালোবাসায় ঘেরা পরিবারের কাছে । আমার সবচেয়ে বড় ভাইয়ের বয়স ছিল তখন নয় বছর, তারপরের বড় বোন আর ভাই ছিল সাত আর পাঁচ বছর, আর আমি ছিলাম নয় মাস!!
দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের কত ত্যাগ, তিতিক্ষা, কত যুদ্ধ , কত আত্মত্যাগ, কত মা বোনের সমভরম .. কত কষ্টের বিনিময়ে এই সাধীনতা।
শহীদ, মুক্তিযাদ্ধা, বীরাংগনা .. তোমাদের ঋন কোনদিন শোধ হবে না।
১৬ ই ডিসেম্বর ১৯৭১..
নয় মাস প্রতীক্ষার পর ..
দুই ভাইকে পাশে নিয়ে শোকে পাগল স্ত্রী, আমার মা বধ্যভূমিতে স্বামীকে খুঁজে বেড়ান!
আমার মা আমার বাবাকে হারিয়ে শোকে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন, বহু বছর অপেক্ষায় ছিলেন আব্বু ফিরে আসবে ।
জীবনে কৃচছসাধন করে, সব স্যাকরিফাইস করে বাবার আদর্শে আমাদের গড়ে তুলেছেন।
আমার চোখে আমার বাবা-মা দুজনেই যোদ্ধা!!
একজন জীবন দিয়েছেন দেশের জন্য, আরেকজন সারা জীবন যুদ্ধ করে আমাদের মানুষ করেছেন!
আমি যুগে, যুগে এমন বাবা-মার গর্বিতা কন্যা হয়েই জন্মাতে চাই!!
আমার বাবার নামে রাজশাহীতে সড়ক আছে, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে অনেক লেখা বের হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে স্মারক ডাকটিকেট বের করেছেন।
২০১৬ সালে বাবাকে মরনোত্তর স্বাধীনতা পদক পুরষ্কারে ভুষিত করা হয়।
আমি, আমার পরিবার আমরা কৃতজ্ঞ, অপরিমেয় গর্বিত। কিন্ত হাজার, হাজার লাখো শহীদ, মুক্তিযাদ্ধা, বীরাঙ্গনা মা-বোনেরা পর্যাপ্ত শ্রদ্ধা, সমমান পাননি।
আমার বাবার সাথে তাঁদের সকলের জন্য পরম শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। আমরা তোমাদের ভুলব না।